আজ রবিবার, ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

নারায়ণগঞ্জে পুলিশের ‘ডোপ টেস্ট’ আতঙ্ক !

সৈয়দ মোহাম্মদ রিফাত

প্রথমবারের মতো পুলিশ সদস্যদের ‘ডোপ টেস্ট’ করা হয়েছিলো মুন্সিগঞ্জে। যার নেতৃত্বে ছিলেন সেখানকার তৎকালীন পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম। এখন তিনি অবস্থান করছেন নারায়ণগঞ্জে। ফলে এ জেলার পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ডোপ টেস্ট নিয়ে একরকম আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে পুলিশেরই একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে সদ্য যোগদান করা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলমই প্রথম ২০১৭ সালে পুলিশ সদস্যদের ডোপ টেস্ট চালু করেন মুন্সিগঞ্জে। যার মাধ্যমে বেশ কয়েকজন মাদকাসক্ত পুলিশ সনাক্ত করা হয়। সেই পুলিশ সদস্যদের তিনি প্রথমবারের মতো মাফ করে চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। তবে নারায়ণগঞ্জের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ থাকছেনা কি না তা সন্দিহান।

নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সদস্যদের ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট করা হবে কিনা জানতে দৈনিক সংবাদচর্চা থেকে মুঠোফোন করা হয় নারায়নগঞ্জ পুলিশ সুপার জায়েদুল আলমকে। তিনি বলেন, মুন্সিগঞ্জের মতো এখানেও তাই করা হবে। যদি কেউ মাদকের সাথে সম্পৃক্ত থাকে তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। মুন্সিগঞ্জ জেলার পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যাদের মাদকের সাথে সম্পৃক্ততা পাওয়া গিয়েছিলো তাদের কয়েকজনকে মামলা দেয়া হয়েছিলো আর কয়েকজনকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিলো। তারপর সেখান থেকে সুস্থ হয়ে তারা ফিরে আসে।

পুলিশ সুপার আরও বলেন, শুধু নারায়ণগঞ্জ নয় দেশের ৬৪টি জেলাতেই যদি কাউকে সন্দেহজনক মনে হয় সেক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট করাতে হবে।

সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ পুলিশেও মাদকাসক্ত গুটিকয়েক কর্মকর্তা রয়েছে। যারা প্রশাসনিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মাদকের সাথে দীর্ঘদিন ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ প্রতিনিয়ত মাদক সেবন করছেন আবার কেউ সোর্স কাজে লাগিয়ে করছেন অবৈধ ব্যবসা।

সচেতন মহলের মতে, নারায়ণগঞ্জ জেলায় সদ্য যোগদান করা এসপি জায়েদুল আলমের চিন্তধারা অন্যান্য এসপির চাইতে ভিন্ন। অতি শীঘ্রই তিনি যেনো ডোপ টেস্টের ব্যবস্থা করেন। তাহলে প্রশাসনের ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা মাদকাসক্তদের মুখ বেরিয়ে আসবে। সেই সাথে এ জেলায় ক্লিন ইমেজধারী পুলিশ জনগনের পক্ষে কাজ করতে পারবে। পুলিশ সুপার জায়েদুল আলমের এমন চিন্তাধারাকে আমরা সাধুবাদ জানাই।

সূত্র মতে, গত বছর ৪ মার্চ নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি কামরুল ইসলামের নির্দেশে মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে উদ্ধারকৃত ৫০হাজার ইয়াবা নিজের বাসায় রেখে আসামীদের ছেড়ে দেন সহকারী উপ পরিদর্শক (এএসআই) মো. সোরওয়ার্দী। উদ্ধার করা সেই ৫০হাজার ইয়াবা থানায় জমা না দেওয়ার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ওসিকে প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ২০১৮ সালের ৭মার্চ এএসআই মোহাম্মদ সরওয়ার্দীর বাসা থেকে ৫০ হাজার ইয়াবা ও ৫ লাখ টাকা উদ্ধার করে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি। এই ঘটনায় দায়েকৃত মামলায় স্বীকারক্তিমূলক জবানবন্দিতে মামলার আসামী নারায়ণগঞ্জ থানার পুলিশ সদস্য আসাদুজ্জামান ও এএসআই মোহাম্মদ সরওয়ার্দী আদালতে বলেন, এটি তারা নারায়ণগঞ্জ সদর থানার ওসির নির্দেশ করেছেন। ওসির নির্দেশেই টাকা ও ইয়াবা নিজের বাসায় রেখে আসামীদের ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, কয়েকবছর আগে ছয়টি সংস্থা পৃথকভাবে মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা জমা দিয়েছিল। ওই ৬ তালিকায় থাকা মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। এসব তালিকা থেকে একটি সমন্বিত তালিকা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে একটি সংস্থার তালিকায় সারা দেশের ২২ হাজার ৪৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৪৭৮ জন ব্যবসায়ীর নাম উঠে আসে। তালিকায় ছিল ছাত্র-শিক্ষক-চিকিৎসক, কর্মচারী, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতা এবং পুলিশ সদস্য।

গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, পুলিশ সদস্যরা মাদক বিক্রেতাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসেহারা নেয়। কেউ কেউ আবার নিজেরাই মাদক ব্যবসায়ের সাথে সম্পৃক্ত। নারায়ণগঞ্জের ২১ পুলিশ সদস্যের নাম উঠে এসেছিল ওই প্রতিবেদনে। এর মধ্যে ফতুল্লা থানার সাবেক এসআই নাহিদ আহমেদ, কামরুল ইসলাম, এএসআই রফিকুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ ডিবির এসআই মোল্লা টুটুল, সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই রফিকুল ইসলাম ও সোনারগাঁ থানার এসআই মফিজুল ইসলাম।

জাতীয় গণমাধ্যম বিশ্লেষণ করে আরও জানা যায় ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, সোনারগাঁ ও রূপগঞ্জ থানায় পোস্টিং পেতে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না অসাধু পুলিশ সদস্যরা। গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জ জেলার ২২জন পুলিশ ও তাদের আটজন সোর্স রয়েছে। যারা ২১ জন মাদক ব্যবাসায়ীকে নিয়ে ৫১ জনের সিন্ডিকেট মিলেমিশে ব্যবসা করছেন। অসাধু ওই ২১ পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন থানার এস আই, কনস্টেবল এমনকি পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত)। অভিযোগ ছিল, উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের টাকা মাসোহারা দিয়ে তারা দীর্ঘদিন ধরে হেরোইন, ফেন্সিডিল, মদ, গাঁজা, ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদক ব্যবসা পরিচালনা করতো। এছাড়া ২১ মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নামও রয়েছে। যে কারণে নারায়ণগঞ্জে মাদক ব্যবসা কোনভাবেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছিল না।